সৈয়দ আবদুল হান্নান আল হাদী:
পৃথিবীতে কোনো ধর্মই অবাধ যৌনাচারসহ অযাচিত জীবনযাপনকে সমর্থন করে না। ধর্মীয় অনুশাসন ও শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপনই প্রত্যেক ধর্মের মূলমন্ত্র। করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে সব ধরনের পাপকর্ম থেকে মুক্ত হয়ে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি।
করোনা মোকাবেলায় লকডাউনের ফলে সাময়িক কর্মহীন হয়ে পড়েছে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। দিনমজুর ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। চলমান সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারের পাশাপাশি সমাজের হৃদয়বান, ধনবান, দানশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কর্তব্য অসহায় কর্মহীন মানুষের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা। এই আপদকালীন দিনগুলো জাকাত, দান-সদকা নিয়ে অসহায়দের পাশে দাঁড়ানোর উত্তম সময়।
এই বিপদের সময় দেশে সব নাগরিকই সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা জরুরি। এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও ঘরে থাকা। এই সময়ে খুব বেশি প্রয়োজন সচেতনতা। বেশি তওবা করে নিজের কৃতকর্মের জন্য বিধাতার কাছে ক্ষমা চাওয়ার এখনই সময়। নিয়মিত ধর্মীয় বিধান মেনে চলা ও সচেতনতাই পারে করোনাভাইরাস থেকে সবাইকে রক্ষা করতে।
করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার মূলমন্ত্র হচ্ছে নিজের সুরক্ষা, পরিচ্ছন্নতা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। এ সামাজিক দূরত্ব মানে, সমাজের একজন মানুষ থেকে আরেকজন মানুষের দূরত্ব। শব্দটি প্রায়োগিক অর্থে হওয়া উচিত নিরাপদ দূরত্ব কিংবা শারীরিক দূরত্ব।
কিছু ক্ষেত্রে হয়তো সচেতনতার অভাবে মনে হতে পারে যে সামাজিক দূরত্বের জন্য একটা মানসিক দূরত্বও তৈরি হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে যিনি বিষয়টি নিয়ে সচেতন, তাকে অপরজনকে সচেতন করতে হবে। তাকে ভালোভাবে বোঝাতে হবে, এটা আমাদের বাঁচার লড়াই। এটি সামাজিক দূরত্ব নয়, সাময়িকভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার এবং অন্যকে বাঁচানোর লড়াই। এখন যেখানেই যান না কেন, দূরত্ব বজায় রেখে কেনাকাটা করতে হবে। কার শরীরে এই রোগজীবাণু ছড়িয়ে আছে তা চোখে দেখে বোঝা অসম্ভব। তাই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখলে আমরা বাঁচতে পারব।
সামাজিক দূরত্বের আসল প্রয়োগ বাড়ির বাইরে, যেখানে নিজে সংক্রমিত হতে পারি, অন্য কাউকে সংক্রমিত করতেও পারি। তাই সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা মানে অপ্রয়োজনে এমন কোথাও না যাওয়া যেখানে আরো মানুষজন আছেন। এক সঙ্গে আড্ডা নয়, খেলাধুলা নয়, প্রার্থনা সভা নয়, কোচিং ক্লাস নয়, এমনি অনেক কিছু। দোকানে ভিড় না করে দূরে দাঁড়িয়ে লেনদেন কিংবা কুশল বিনিময় করতে কোনো সমস্যা নেই। বাড়ি থেকে ফোন করে যা যা দরকার জানিয়ে সেটা চুপচাপ নিয়ে আসা উচিত। অর্থাৎ নিজের নিরাপদ দূরত্ব রক্ষা করে সব কিছু করা যাচ্ছে। আর এতে সংক্রমণের আশঙ্কাও কম। তাই বলা চলে মূলত নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখলেই চলে।
আসলে আমাদের দেশের যারা খেটেখাওয়া মানুষ তাদের কাছে সমাজতত্ত্ব, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ প্রভৃতি মূল্যহীন। এসব বোঝার সময় তাদের নেই। আমাদের বিশাল একটি অংশ বোঝে শুধু, দিনশেষে ঘরে খাবার আছে কি না, শিশুর স্কুলের বেতন-ফি রেডি হয়েছে কি না, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল ও বাড়িভাড়া রেডি আছে কি না।
তাদের বোঝাতে হবে দয়া করে আপনারা একে অপর থেকে দূরত্ব রক্ষা করে চলুন। এতে আপনিও ভালো থাকবেন; আপনার পরিবার বা আশপাশে যারা আছে তারাও ভালো থাকবেন। তাই আমরা সবাইকে বলব, নিরাপদ দূরত্ব রক্ষা করে চলুন। আশপাশে যারা আছেন তাদের সাথে কুশল বিনিময়ের নানা মাধ্যম আছে।
বলতে হবে যে, আপনারা সবাই নিজেদের মধ্যে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখেন। তিন ফুট দূরে দূরে দাঁড়ান। এভাবে তাদের বোঝাতে হবে। এতে কাজ হবে আমাদের বিশ্বাস।
গোটা পৃথিবী থমকে গেছে করোনাভাইরাসে। সব দেশের সব বুদ্ধি ও সামর্থ্য দিয়ে থামাতে চাচ্ছে কোভিড-১৯ এর আক্রমণ। এ যেন এক রণক্ষেত্র। পরাস্ত হচ্ছে সমগ্র বিশ্ব। মারা গেছে প্রায় ২ লাখ মানুষ। কী ভয়াবহ!
এর থাবা থেকে আমরাও রেহাই পাচ্ছি না। প্রতিদিন আমাদের দেশে আক্রান্তের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। বাংলাদেশে চিকিৎসকসহ বহু মানুষ চিরবিদায় নিয়েছেন। আক্রান্ত প্রায় তিন হাজার। তার পরও কি আমরা সচেতন?
আমাদের ঘরে থাকার জন্য সারা দেশে লকডাউন চলছে। আমাদের সচেতন করতে কাজ করছেন চিকিৎসক, নার্স, চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান। কাজ করছে পুলিশ, সেনাবাহিনী, ব্যাংকার, গণমাধ্যমের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। এসবের পরও আমরা কতটুকু সচেতন?
গত ১৮ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মাওলানা জুবায়ের আহমেদ আনসারীর নামাজে জানাজায় লকডাউন কিংবা স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি করোনার ভয় কি একটুও বাড়াতে পেরেছে? আমরা নিয়ম মানা কিংবা সচেতনতাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে তাচ্ছিল্য করলাম।
ত্রাণ দিতে যে মহড়া লক্ষ করা যায়, সেটি করোনাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে আনার মতো। সমাজসেবা অধিদফতরের একটি পিকআপ গাড়িতে ভাসমান মানুষের জন্য রান্না করা খাবার বিতরণ করতে এলে দেখা যায়, উপস্থিত জনতা নিজেরাই সব স্বাস্থ্যবিধি পদদলিত করে খাবার ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে। কর্তৃপক্ষ নির্বিকার! সেখানে ছিল না ‘সামাজিক দূরত্ব’।
দেখা যায় ত্রাণ নিতে এক জায়গায় সব জড়ো হয়ে বসে থাকতে। কারণ কোনো দানশীল ব্যক্তি কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠান ত্রাণের গাড়ি থামিয়ে দেবে এই ভিড় দেখে। সম্প্রতি পাবনায় শত শত মানুষ একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গেট ভেঙে ট্রাক থেকে ত্রাণ নিতে দেখা গেছে। অথচ সেটা ছিল চরম ঝুঁকিপূর্ণ। নিজের ব্যানার টানিয়ে, ক্যামেরায় সে দৃশ্য বন্দী করে, সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে ত্রাণ বিতরণের এই মহড়া আমাদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। ব্যাংকে গ্রাহকের উপচে পড়া ভিড় দেখে বোঝার উপায় নেই এ দেশে ‘করোনা’ বলে কিছু আছে। এক জুমায় বায়তুল মোকাররম মসজিদে ইমামসহ মুসল্লি ছিলেন ১০ জন। আর সেই সংবাদ প্রচারের জন্য ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত ২০ জন, যেখানে ছিল না সামাজিক দূরত্ব। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা ছবি ভাইরাল হয়েছিলÑ সেনাবাহিনীর একজন সদস্যকে দেখেই তাড়াতাড়ি এক ব্যক্তি তার লুঙ্গির গিট্টুটা খুলে নাগের ডগায় দিলো। সেনাসদস্য জানতে চাইলে উত্তর দিলো, মুখে মাস্ক থাকলে কিছু বলবেন না তো তাই।
পোশাক শ্রমিকদের ট্রাকে গাদাগাদি করে রাজধানীতে ফিরতে দেখেছি। দেখেছি, পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে মাছের ড্রামভর্তি মানুষ। বাজারগুলোতে ভিড় দেখলে সচেতন যেকোনো মানুষের গা শিউরে উঠবে।
দেখেছি সরকারি একজন চাকরিজীবী অফিস ছুটির এ সুযোগে তার বিয়ে কাজটা সম্পন্ন করছেন। সাথে লোকসমাগম। তখন প্রশ্ন জাগে আমাদের অর্থনীতি ক্ষতির সম্মুখীন হবে জেনেও সরকার কাদের রক্ষা করতে এই ‘সাধারণ ছুটি’ দিয়েছিল? আমরা পুলিশ দেখলেই গলির ভেতর ঢুকে যাচ্ছি, পুলিশের গাড়ি চলে গেলেই আবার আগের মতো। নিজেদের কতই না চালাক ভাবছি।
কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়েছে করোনার, যা ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে নিজেরা বের হচ্ছি, পুলিশ জিজ্ঞেস করলেই বলছি ওষুধ কিংবা চাল কেনার কথা। এসবের মধ্যে চাল চোর কিংবা খাটের নিচে খাঁটি তেলের কাহিনী তো আছেই। পুরো দেশটা কিছু অসচেতন নাগরিকের জন্য কি ঝুঁকিতে পড়বে? আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে, মানতে হবে নিয়ম, সরকারি নির্দেশনা। কিন্তু আমরা কবে নিয়ম মানব?
মহান আল্লাহর করুণা ছাড়া আমাদের নিস্তার নেই। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ তথা হুকুম মেনে চললে করোনাসহ সব ধরনের বিপদ থেকে আমরা সবাই মুক্ত হবো ইনশা আল্লাহ।
লেখক : চেয়ারম্যান, ইসলামিক বুদ্ধিজীবী ফ্রন্ট